• বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৮ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

রাসূল (সা.) এর চিঠি

লালমনিরহাট বার্তা

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর ২০১৮  

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতির কাজ করার ক্ষেত্রে মৌখিক দাওয়াতি যেমন দিয়েছেন তেমনি লিখিত দাওয়াতও দিয়েছেন প্রচুর।

সীরাতের মাসে সেই চিঠিগুলোও আমাদের জানা পড়া দরকার। এই থেকে দাওয়াতি কাজের ধরণ ও ধারনা লাভ করা যেতে পারে। হাদিসের কিতাবগুলোতে বহু চিঠির আলোচনা এসেছে। অনেক বড় বড় রাজা বাদশার দরবারে চিঠি পাঠাননি। সরারসি কোনো দূত মারফত দাওয়াত পাঠিয়েছেন। হাদিস ও ইতিহাসের কিতাবে রাসূল (সা.) এর চিঠি প্রেরণের প্রসিদ্ধ কয়েকটি চিঠি এখানে তুলে ধরলাম।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম হজরত হাসান রাযিআল্লাহু আনহু থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেস্রা (রোম সম্রাট), নাজ্জাশী প্রমুখ বড় বড় রাজন্যবর্গের কাছে পত্র লিখেন, যাতে তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেওয়া হয়। (বলা বাহুল্য, এই নাজ্জাশী সেই নাজ্জাশী নয়, যার জানাযার নামাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়িয়েছিলেন।)

ইবনে আবী শায়বা মুসান্নাফ গ্রন্থে বলেন- রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারজন বড় বাদশাহের কাছে চারজন দূত প্রেরণ করেন। কেস্রা, কায়সর এবং মুকাউকিস। আর নাজ্জাশীর কাছে প্রেরণ করেন আমর ইবনে উমাইয়াকে। দূতগণ যেখানে যেখানে প্রেরিত হন, তারা সেই জন গোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলতেন।

 

ইবনে সা’দ বুরায়দা যুহরী ও ইয়াযীদ ইবনে রুমান থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল লোককে অন্য দল লোকের কাছে প্রেরণ করলেন, যাতে তারা তাদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেন। এই দল যে জনগোষ্ঠীর কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন, তারা সেই জনগোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলতেন।

হেমইয়ারী রাজন্য বর্গের কাছে পত্র প্রেরণ:

ইবনে সা’দ রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারেছ, মকরুহ, নাঈম ইবনে আবদে কেলাল প্রমুখ হেমইয়ারী রাজন্যবর্গের কাছে ইসলামের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন। পত্রবাহক ছিলেন আইয়াশ ইবনে রবীআ মখযুমী রাযিআল্লাহু আনহু। বাহককে এই মর্মে উপদেশ দেওয়া হলো যে, যখন তুমি হেমইয়ারের ভূমিতে পৌঁছবে, তখন রাতের বেলায় সেখানে প্রবেশ করবে না। ভোড়ে ওজু করে দু’রাকআত নামাজ পড়বে এবং আল্লাহর কাছে প্রয়োজন পূরণের দোয়া করে প্রবেশ করবে। আমার পত্র ডান হাতে রাখবে এবং তাদের ডান হাতে দিবে। যখন তারা পত্র গ্রহণ করবে তখন তুমি এই আয়াত পাঠ করবে لم يكن الذين كفروا من أهل الكتاب إلي أخره এরপর أمنت بمحمد وانا اول المسلمينবলবে।

তোমার সামনে পেশকৃত প্রমাণাদি বাতিল হয়ে যাবে। তারা যখন তোমার সামনে কোনো অনারব ভাষার বাক্য পাঠ করবে, তখন তুমি বলবে এর অনুবাদ কর। তারা যখন মুসলামান হয়ে যাবে, তখন তুমি তিনটি শাখা সম্বন্ধে জেনে নিবে, যেগুলো সেজদা অবস্থায় তাদের সম্মুখে আসে। তুমি সেই শাখাগুলো বের করে প্রকাশ্য জায়গায় আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দিবে। আইয়াশ রাযিআল্লাহু আনহু বলেন: আমি হেমইয়ারে পৌঁছে আদেশ অনুযায়ী কাজ করলাম এবং রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছিলেন, তাই হলো।

জলবসীর নামে পত্র প্রেরণ:

ইবনে ইসহাক রেওয়ায়েত করেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনুল আস রাযিআল্লাহু আনহুকে পত্রসহ আম্মানের বাদশাহ জলবসীর কাছে প্রেরণ করেন। সে বলল: আমি কয়েকটি কারণে এই নবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। তিনি যে বিষয়ের আদেশ করেন, প্রথমে নিজে তা করেন এবং যে বিষয়ে নিষেধ করেন, প্রথমে নিজে তা ত্যাগ করেন। বিজয় লাভের কারণে গর্ব ও অহংকার করেন না। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ জয়ী হলে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে না। তিনি অঙ্গীকার পূর্ণ করেন। আমি সাক্ষ্য দেই যে, তিনি নবী।

বনী-হারেছার কাছে পত্র প্রেরণ:

আবু নঈম রেওয়ায়েত করেন যে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী-হারেছা ইবনে আমর রাযিআল্লাহু আনহুকে পত্র লিখেন এবং ইসলামের দাওয়াত দেন। আমর তাঁর পত্র বালতির পানিতে ধৌত করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহ তায়ালা এদের জ্ঞানবুদ্ধি ছিনিয়ে নিয়েছেন। এরা ভীরু ও অসহিষ্ণু। তাদের কথাবার্তা মিশ্র। এরা সীমাহীন নির্বোধ। ওয়াকেদী বলেন: আসলেও এই সম্প্রদায়ের কতক লোক স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেও সক্ষম ছিল না।

বায়হাকী রেওয়ায়েত করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো একজন সাহাবীকে জনৈক মুশরিক সরদারের কাছে প্রেরণ করেন এবং তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। মুশরিক সরদার বলল: যে আল্লাহর দিকে আপনি আমাকে দাওয়াত দেন, সে সোনার তৈরি, না রূপার তৈরি, না পিতলের তৈরি? একথা শুনে সাহাবী ফিরে এলেন। আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে বজ্রপাতের মাধ্যমে সেই মুশরিককে জালিয়ে ভস্মীভূত করে দেন। দূত সাহাবী তখনও পথিমধ্যেই ছিলেন এবং তিনি এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দেন মুশরিক ভস্মীভূত হয়ে গেছে।

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ ও ব্যক্তিবর্গের কাছে ইসলামের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেছিলেন, তেমনি আরবের বিভিন্ন গোত্রের পক্ষ থেকে অনেক দূত ও প্রতিনিধিদল তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়েছিল। এই দূতদের আগমনের সময় যে সকল মোজেযা প্রকাশ পেয়েছিল, নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হরো।

মুকাউকিসের নামে পত্র প্রেরণ:

বায়হাকীর রেওয়ায়েতে হাতেব ইবনে আবী বালতাআ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আলেকজান্দ্রিয়ার সম্রাট মুকাউকিসের কাছে পত্রসহ প্রেরণ করলেন। আমি সেখানে পৌঁছলে সম্রাট আমাকে তার প্রাসাদে স্থান দিলেন। আমি তার কাছে অবস্থান করলাম। একদিন তিনি আমাকে ডাকলেন এবং পাদ্রীদেরকেও সমবেত করলেন। অতপর সম্রাট বললেন: তুমি তোমার নবী সম্পর্কে বল। সত্যিই তিনি নবী নন? আমি বললাম: নিঃসন্দেহে তিনি নবী। : তা হলে তার সম্প্রদায় যখন তাঁকে মক্কা থেকে বহিষ্কার করল- তখন তিনি বদদোয়া করলেন না কেন? :আপনারাও তো বলেন যে, ঈসা ইবনে মারিয়াম আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসূল। তার সম্প্রদায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য আটক করলে তিনি বদদোয়া করলেন না কেন? তিনি বদদোয়া করেননি। আল্লাহ তাকে আকাশে তুলে নিয়েছেন। : তুমি সমঝদার এবং সমঝদারের কাছে এসেছ।

ওয়াকেদী ও আবূ নঈম রেওয়ায়েত করেন যে, মুগীরা বনী মালেকের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুকাউকিসের কাছে গেলে মুকাউকিস বললেন : তোমরা আমার কাছে কিরূপে পৌঁছলে? তোমাদের মধ্যে ও আমার মধ্যে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর দলবল অন্তরায় ছিল। মুগীরা বলল : আমরা সমুদ্রের কিনার ধরে ভখয়ে ভয়ে এ পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। : মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতের ব্যাপারে তোমরা কি করেছে? সে জওয়াব দিল, আমাদের কেউ তার অনুসরণ করেনি।

মুকাউকিস কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলল- তিনি যে ধর্ম এনছেন, আমাদের বাপ দাদা কেউ এ ধর্ম পালন করেনি। আমাদের শাসনকর্তাও এ ধর্ম মানে না। আমরা আমাদের পৈতৃক কর্মের ওপরই আছি। মুকাউকিস প্রশ্ন করলেন- তার আপন গোত্র কি করেছে? মুগীরা বলল : যুবক শ্রেণীই তার অনুসরণ করেছে। এছাড়া তার গোত্র এবং আরবের অধিবাসীরা তাঁর বিরোধিতা করেছে। তারা তাঁর সাথে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছে। জয় পরাজয় উভয় পক্ষেই হয়েছে। মুকাউকিস বললো : আমাদের তাঁর দাওয়াত সম্পর্কে অবগত কর। তারা বলল : তার দাওয়াত হচ্ছে এক আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোনো শরীক নেই। আমাদের বাপ দাদারা যে সকল প্রতিমার পূজা করেছে সেগুলো ছেড়ে দিতে বলে। নামাজ পড়তে বলে, জাকাত দিতে বলে।

মুকাউকিস বলে : নামাজ ও জাকাতের পরিমাণ কী? তারা বলল : দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত। ওয়াক্তগুলো নির্ধারিত। আর বিশ মেসকাল স্বর্ণের উপর যাকাত আদায় করে। পাঁচটি উট হলে একটি ছাগল জাকাত আদায় করে। মুকাউকিস বলল : মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাকাত নিয়ে কি করে? তারা বলে : তিনি এই জাকাত নিঃস্বদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। এছাড়াও তিনি আত্মীয়তা বজায় রাখা ও অঙ্গীকার পূর্ণ করা আদেশ দেন এবং ব্যভিচার মদ্যপান সুদ খেতে নিষেধ করেন। তাঁর অনুসারিরা আল্লাহর নাম ব্যতীত যবেহ করা প্রাণী খায়না। এসব কথা শুনে মুকাউকিস বলে উঠেন তিনি সমগ্র মানুষের জন্য নবী। মিসরীয় কিবতী এবং রোমকরাও তার অনুসরণ করবে। এসব বিধি-বিধান নিয়েই হজরত ঈসা আলাহিস সালাম আগমন করেছিলেন। আর এসব নীতিমালা নিয়ে দুনিয়ায় নবীরা আগমন করেন।

 

তোমার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একজন নবী হবেন। কেউ যেন তাঁর সঙ্গে কলহে লিপ্ত না হয়। তার মতবাদ ও মতাদর্শ সেই পর্যন্ত পৌঁছবে যে পর্যন্ত উট ও ঘোড়া যেতে পারে। সমুদ্রের গভীরতা পর্যন্ত তার ধর্ম প্রচার হবে। এই কথা শুনে মুগীরা ও তার সাথীরা বলল- সমস্ত মানুষ এই দ্বীনকে কবুল করে নিলেও আমরা কখনোই এই ধর্ম গ্রহণ করবো না। একথা শুনে মুকাউকিস মাথা হেলালেন এবং বললেন- তোমরা ক্রীড়া ও খেলতামাশায় মেতে আছো। এরপর তাদের মধ্যে আরো প্রশ্নোত্তর হলো। মুকাউকিস বললো- তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশপরিচয় মর্যাদা কেমন?

: মাঝারি স্তরের বংশ

: নবীগণ এমন বংশেরই হন

: তার সত্যবাদিতা কেমন?

: তার এমন সত্যবাদিতা যে, সকলে নির্বিশেষে তাকে আমিন বলে ডাকে।

: সে যদি তোমাদের ব্যাপারে মিথ্যাবাদী না হয়? তাহলে আল্লাহর ব্যাপারে কিভাবে মিথ্যাবাদী হতে পারে? এভাবে মুগীরা বলে তার সব কথাই সত্য প্রমাণিত হলো।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –