• বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৮ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

খালিদ বিন ওয়ালিদ আজীবন অপরাজিত ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি

লালমনিরহাট বার্তা

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর ২০১৮  

আমি শাহাদাতের ইচ্ছা নিয়ে এত বেশি যুদ্ধে লড়াই করেছি যে আমার শরীরের কোনো অংশ ক্ষতচিহ্নহীন নেই যা বর্শা বা তলোয়ারের আঘাতের কারণে হয়নি। এরপরেও আমি এখানে, বিছানায় পড়ে একটি বৃদ্ধ উটের মতো মারা যাচ্ছি। কাপুরুষদের চোখ যাতে কখনো শান্তি না পায়।” — খালিদ বিন ওয়ালিদ

খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ছিলেন মুসলিম ইতিহাসে এক মহান সেনাপতি। যিনি রণক্ষেত্রে নিজের শক্তি ও মেধার দ্বারা ইসলামের ঝান্ডাকে বুলন্দ করেছিলেন। মিসরের খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক আববাস মাহমুদ আল-আক্কাদ ‘আবকারিয়াতু খালিদ’ নামক গ্রন্থে তাঁর সামরিক ব্যক্তিত্বের পর্যালোচনা করে বলেন, ‘সামরিক নেতৃত্বের সব গুণাবলীই খালিদ (রাঃ)-এর মধ্যে ছিল। বাহাদুরী, সাহসিকতা, উপস্থিত বুদ্ধি, তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন, অত্যধিক ক্ষিপ্রতা এবং শত্রুর উপর অকল্পনীয় আঘাত হানার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।

শুরুতে সাহসী এই বীরের বিনয় ও আনুগত্যের একটি ঘটনা জানা যাক।

৬৩৮ সালে খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে এডেসা, দিয়ারবাকির, মালাতিয়া, আরারাত এবং জাজিরার উত্তরের বাইজেন্টাইন অঞ্চল জয় করার পর মুসলমানদের মধ্যে খালিদ হয়ে উঠেন জাতীয় বীর। এরপর খালিদ মারাশ অধিকার করেন। এর কিছুদিন পর খালিদ জানতে পারেন খ্যাতনামা কবি আশ’আস খালিদের প্রশংসা করে কবিতা রচনা করেছেন। খালিদ খুশি হয়ে কবিকে ১০০০০ দিরহাম উপহার হিসেবে দেন। এটা খলিফা ওমর (রা) ভালো চোখে দেখেননি। তাই তিনি তদন্তের প্রয়োজন অনুভব করেন।

খলিফা ওমর (রা) খালিদ এর দান করার অর্থের উৎস বের করতে তদন্তের দায়িত্ব দেন আবু উবাইদাকে। আবু উবাইদার জন্য এ কাজটি করা কঠিন ছিলো।আবু উবাইদা অত্যন্ত পছন্দ করতেন খালিদকে। নিজের ছোট ভাইয়ের মতো আদর,স্নেহ আর ভালোবাসা ছিলো খালিদের প্রতি।   তাই তিনি বিলাল ইবনে রাবাহকে এই দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়ে বিলাল খালিদকে চেলসিস থেকে এমেসায় ডেকে আনেন এবং জানতে চান এ অর্থ তিনি কোথা থেকে পেলেন। খালিদ বলেন তিনি নিজের অর্থ থেকে এই উপহার দিয়েছেন। এরপর আবু উবাইদা ওমরের নির্দেশ খালিদ বিন ওয়ালিদকে শুনিয়ে দেন, এটি ছিলো “যদি খালিদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে উপহার দেন তবে তা ক্ষমতার অপব্যবহার। আর যদি তিনি নিজের অর্থ প্রদান করেন তবে তা অপচয়। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং উমরের নির্দেশে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে”। খলীফার উক্ত অব্যাহতি আদেশ খালিদ বিন ওয়ালিদ অবনত মস্তকে মেনে নেন।

খালিদ বিন ওয়ালিদের ইসলাম গ্রহনের কাহিনী অত্যন্ত চমৎকার। তখনো খালিদ কাফির সৈনিক । একদিন রাসুল (সঃ) আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন ” হে আল্লাহ খালিদ ইবনু ওয়ালিদ, সালামা ইবনু হিশাম এবং দুর্বল মুসলমানদেরকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্তি দান করুন” । এ দোয়ার পরে ৭ম হিজরিতে খালিদ ইসলাম গ্রহন করেন। কিন্তু কিভাবে তার মনে ইসলাম প্রবেশ করেছিলো? খালিদের ভাই ওয়ালিদ বদর যুদ্ধে মুসলমানদের কাছে বন্দি হয়। তাকে মুক্ত করার জন্য খালিদ ও তার বড় ভাই হাশাম বিন ওয়ালিদ মদিনায় মুক্তিপণ দিতে গিয়েছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর মক্কায় ফেরার পথে ওয়ালিদ পুনরায় মদিনায় ফিরে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। এটা খালিদের মনে দাগকাটে।

রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মৃত্যুর পর কিছু বড় বড় গোত্র প্রথম খলিফা আবু বকর (রাঃ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিছু সংখ্যক মুসলমান তাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যায়। কিছু লোক ভণ্ড নব্যুয়তের দাবী করে বসে, অনেকে ইসলামি কোষাগারে যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, এরকম  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। যা খলিফা আবু বকর (রাঃ) শক্ত হাতে দমন করেন। ইসলাম ত্যাগী তথা রিদ্দার যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের কিছু শক্তিক্ষয় করলেও তাদের ভিতরের যে সকল লোক শুধু মুখে বা ক্ষমতা দখলের জন্য সুযোগ সন্ধান করছিল, তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং তারা সমূলে উৎপাটিত হয়। এতে করে মুসলমানদেরই অনেক উপকার হয়। তারপরই শুরু হয় ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধের দামামা। যার নেতৃত্ব দেন খালিদ বিন ওয়ালিদ।

ইসলাম গ্রহনের পূর্বে উহুদের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ডান বাহুর নেতৃত্বে ছিলো খালিদ বিন ওয়ালিদ। এ যুদ্ধে মুসলমান বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৭৫ জনের মত শহীদ হয়।  বদরে পরাজিত কাফের বাহিনীকে উহুদ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে আসে বাহাদুরি, সাহসিকতা, উপস্থিত বুদ্ধি ও তীক্ষ্ন মেধাসম্পন্ন খালিদ।  যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুসলিমদের প্রবল আক্রমনের মুখে কুরাইশ বাহিনী পিছু হটে গেল এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। মুসলিমদের একটি দলকে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) অনড় থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্যালী পাহারা দেবার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন এবং কোন অবস্থাতেই সে স্থান ত্যাগ না করার জন্য আদেশ করেছিলেন। কুরাইশ বাহিনী পিছু হটে যাবার পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভের আশায় এ দলটির অধিকাংশ সদস্য রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নির্দেশ ভুলে গিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। খালিদ মুসলিমদের এ স্থানচ্যুতির সুযোগে পেছন থেকে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমন করে বসলো এবং মুষ্টিমেয় যে কজন মুসলিম রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নির্দেশ মেনে সে স্থানটি পাহারা দিচ্ছিল তাদের হত্যা করে মুসলিম বাহিনীকে অপ্রত্যাশিত আক্রমনে বিপর্যস্ত করে ফেললো। এ যুদ্ধ জয়ে খালিদের বিচক্ষণতা একটা বিষয়ে স্পষ্ট বোঝাযায়, তাহলো রাসুল (সঃ) যে স্থানটিকে অরক্ষিত রাখা বিপদজনক মনে করেছিলেন, খালিদ আক্রমনের জন্য সেই স্থানকেই বেছে নিয়েছিলেন।

উহুদ ময়দান

খালিদ বিন ওয়ালিদ ইসলাম গ্রহণের পর কোন যুদ্ধে পরাজিত হননি। ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খালিদ মাত্র ১৪ বছর জীবিত ছিলেন। এ অল্প সময়েই তিনি মোট ১৫০ টি ছোট-বড় যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। দ্রুত সম্প্রসারমান ইসলামী সাম্রাজ্য খালিদের সময়েই মুসলমানদের হস্তাগত হয়। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুতার যুদ্ধে বাইজেন্টাইন মুসলমানদের দখলে আসে। রোমানদের বিপক্ষে এটি মুসলিমদের প্রথম লড়াই ছিল। এই যুদ্ধের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে খালিদের নয়টি তলোয়ার ভেঙে গিয়েছিল। যুদ্ধে সেনাপতি জায়িদ ইবনে হারেসা , জাফর ইবনে আবি তালিব ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ক্রমান্বয়ে নিহত হওয়ার পর খালিদ সেনাপতি হিসেবে ভার নিয়েছিলেন। এসময় তার অধীনে মাত্র ৩,০০০ সৈনিক ছিল। অন্যদিকে বাইজেন্টাইন ও তাদের মিত্র গাসানি আরবদের ছিল ১০,০০০ সৈনিক। এই কঠিন পরিস্থিতিতে খালিদ মুসলিম সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কৌশল প্রয়োগ করে তিনি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পরিস্থিতি থেকে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন।

খালিদ এর রণনিপুণতায় খুশি হয়ে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ রাসুল (সা.) তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি মহানবী (সা.) এর জীবদ্দশায় মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, তায়েফ বিজয়, তাবুক অভিযান ও বিদায় হজে অংশগ্রহণ করেন। তিনি খলিফা আবুবকর ও খলিফা ওমর (রা.) এর খিলাফতকালে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দমনের পর খালিদ ইরাক অভিমুখে রওয়ানা দেন। আনবার, আইনুত তামুর, দুমা, হীরা ও সোনা প্রভৃতি অঞ্চল অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বিজয় লাভ করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ সর্বশেষ যুদ্ধ করেন ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে। ফোরাতের এক তীরে মুসলিম বাহিনী অপর তীরে ইরাকী বাহিনী। ইরাকীদের প্রস্তাবমতে তাদেরকে নদী পার হবার সুযোগ দিলে তারা নদী পার হয়। মুসলিম বাহিনী শত্রু বাহিনীকে তিন দিক ঘিরে ফেলে। তাদের পিছনে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা বিশাল নদী। সামনে মুসলিম সৈন্যদের তরবারীর ভেদ। পিছনে সুবিশাল সমুদ্র। পালানোর কোন পথ নেই। সামনে অতিক্রম করলে তরবারীর আঘাত আর পিছনে ফিরে গেলে ডুবে মরা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। অতঃপর মুসলিম বাহিনী শত্রু পক্ষকে কঠিনভাবে আক্রমণ করে। ফলে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন।

রাসুল (সা.) খালিদ বিন ওয়ালিদ কে ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত করেন।

ইরাক জয়ের পরপরই খালিদ (রাঃ) খলীফার নির্দেশে বসরায় যান ও পূর্বে অবস্থানরত মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগদান করেন। খালিদ সেখানে পৌঁছেই বসরায় আক্রমণ করেন। তার আক্রমণে হতভম্ব হয়ে বসরাবাসী ৬৩৮ খৃষ্টাব্দে তাদের শান্তি চুক্তি করে। এরপর খালিদ সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। সিরিয়ায় অভিযানের প্রথমেই খালিদ দামেশক অবরোধ করেন। সেখানে খালিদ প্রায় ছয়মাস অবরোধ করে রাখেন। কিন্তু দুর্গ প্রাচীর অতিক্রম করতে পারেন নি। এ সময় এক পাদ্রীর পুত্র সন্তান জন্মের কারণে আনন্দে নগরীর অধিবাসীরা মদপানে মত্ত ছিল। তাই সময় বুঝে একদিন রাতে খালিদ তাঁর কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে দুর্গ প্রাচীর অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করেন ও দ্বাররক্ষীদের হত্যা করেন। ফলে নগরের প্রধান ফটক মুসলমানদের নিকট উন্মুক্ত হয়। অকস্মাৎ আক্রমণে ভীত হয়ে তারা তরিৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করে। খালিদ ইবনু ওয়ালীদ যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান বিভিন্ন কমান্ডার পৃথকভাবে সৈন্য পরিচালনা করছেন। তখন খালিদ যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে এক গুরুগম্ভীর ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘আজকে এ দিন আল্লাহ্র নিকট অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। তোমরা গর্ব অহংকার থেকে বিরত থাক। তোমরা খালেছভাবে যুদ্ধ কর। তোমাদের কাজের জন্য প্রভুর সন্তুষ্টি কামনা কর। এসো আমরা নেতৃত্ব ভাগাভাগি করি। কেউ আজ কেউ আগামী ও কেউ পরশু আমীর হই। আর আজকের দিন আমার উপর ছেড়ে দাও’।

অতঃপর তাঁর এই তেজোদীপ্ত বক্তব্য সকলে সমর্থন দিল। প্রধান সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে খালিদ মুসলিম সেনাদলকে এমনভাবে বিন্যস্ত করলেন যে আরবরা কোনদিন এমন বিন্যস্তকরণ চোখে দেখেনি । অতঃপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। রোমানরা এমনভাবে আক্রমণ করল যে আরবরা এরকম বিপদে ইতিপূর্বে কখনও নিমজ্জিত হয়নি। মুসলিম বাহিনীর মাঝখানের দায়িত্বে ছিলেন কাকা ও ইকরামা । খালিদ তাদেরকে ও সমস্ত মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। ফলে যুদ্ধ সর্বোচ্চ রূপ ধারণ করল। হযরত খালিদও তীব্র আক্রমণ চালালেন। তিনি যে দিক গেলেন সে দিকের রোমান বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের শোচনীয় পরাজয় হল।এ যুদ্ধে লক্ষাধিক রোমান সৈন্য নিহত হয়।

এরপর মুসলমানরা জেরুজালেমের বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে। এ অবরোধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপ্রধানদের মধ্যে খালিদও ছিলেন একজন। বায়তুল মুকাদ্দাসের অধিবাসীরা বাঁচার কোন পথ না পেয়ে স্বয়ং উমার (রাঃ)-এর নিকট সন্ধিচুক্তি করার প্রস্তাব দেন। তাদের অনুরোধে উমার (রাঃ) সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এভাবেই প্রত্যেক যুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের সুতীক্ষ্ম ও সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদান করে ইসলামের বিজয় পতাকা বিশ্বের ময়দানে উড্ডীন করেন।

সম্রাট হেরাক্লিয়াসের প্রধান সেনাপতি মাহানের অধীনে অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার সৈন্য বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলো ইয়ারমুকের যুদ্ধে। মাহান দূতের মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীর সাথে কথা বলার প্রস্তাব দেয়। ১০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে রোমক সেনাপতির শিবিরে গিয়ে পৌঁছেন খালিদ। সেনাপতি মাহানের উদ্দেশ্য ছিলো ভয় ভীতি, শান শওকত ঐশ্বর্য দেখিয়ে মুসলিমদের দূর্বল করা কিন্তু খালিদ যখন স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত ও কারুকার্য-খচিত চেয়ারগুলো সরিয়ে রেখে নিঃসংকোচে মেঝেতে আসন গ্রহণ করলেন, তখন সেনাপতি মাহান নিজেই মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়েন। আলোচনা হয়। মাহান প্রস্তাব দেন মুসলমানরা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে বিনিময়ে প্রত্যেক মুসলিম সৈন্যকে একশত দিনার, মুসলিম সেনাপতিকে তিনশত দিনার এবং খলিফাকে দশ হাজার দিনার দান করবে। কিন্তু দুটি পাল্টা প্রস্তাব রাখলেন ইসলাম গ্রহণ করুন নতুবা যিযিয়া দিন। রোমক সেনাপতি দাম্ভিকতার সঙ্গে প্রত্যাখান করে, তরবারির মাধ্যমে ফয়সালার ঘোষণা দেন।

খালিদ বিন ওয়ালিদ স্পষ্ট অথচ কঠোর ভাষায় জানিয়ে দেন, যুদ্ধের বাসনা তোমাদের চেয়ে আমাদেরই বেশি এবং আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পরাজিত করব। আর বন্দি করে খলিফার দরবারে হাজির করব। মাহান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল, এখনই তোমার সামনে তোমাদের পাঁচজন সঙ্গীকে হত্যা করছি। দুই লক্ষাধিক সৈন্য বাহিনীর সামনে সেনাপতি মাহানকে জিন্মি করে ১০০ অশ্বারোহী মুসলিম সৈন্যকে নিয়ে স্বীয় তাঁবুতে ফিরে আসেন খালিদ। যা ছিল ইয়ারমুক যুদ্ধে জয়লাভের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীতে হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বেই ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয় লাভ করেন।

খলীফা উমার (রাঃ) খালিদ (রাঃ)-কে ৬৩৮ খৃষ্টাব্দে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেন। কারন আগেই বর্ননা করেছি । অতঃপর খলীফা ওমর (রাঃ) সর্বত্র ঘোষণা দেন যে, ‘আমি খালিদকে আস্থাহীনতা, ক্রোধবশতঃ বা এ জাতীয় কোন কারণে অপসরণ করিনি। শুধুমাত্র এ কারণে পদচ্যুত করেছি যে, মুসলমানরা জেনে নিক যে, খালিদের শক্তির ওপর ইসলামের বিজয়সমূহ নির্ভরশীল নয়। বরং ইসলামের বিজয় আল্লাহর মদদ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ”

প্রধান সেনাপতি থেকে অব্যহতির পর সাধারণ সৈনিক বেশে বাকি যুদ্ধে শরীক থাকেন খালিদ। তারপর খলীফা তাকে সিরিয়ার রাহা, হিরাত, আমদ এবং লারতার অঞ্চলসমূহের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । অতঃপর তিনি খলীফা প্রদত্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে দ্রুত সিরিয়ায় গমন করেন। তিনি ইয়াযীদকে লেবানন, আমর (রাঃ)-কে জেরুজালেম, সুরাহবিলকে জর্দান অভিমুখে পেরণ করেন এবং তিনি দ্রুত গতিতে বলবেক, এডেসা, আলেপ্পো, কিন্নিসিরিন প্রভৃতি স্থান দখন করে সমগ্র সিরিয়া অঞ্চলে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। আর এভাবে তিনি একজন সুদক্ষ সেনানায়ক থেকে একজন সুযোগ্য রাষ্ট্রীয় শাসকে পরিণত হন।সেখানে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর স্বেচ্ছায় অবসর নেন।

ইসলামী আইনের অধীনে থেকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহনে খালিদ যেমন ছিলেন উদার তেমন কঠোর। মেসোপটেমিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে খালিদ প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন :

“ইসলামে প্রবেশ কর এবং নিরাপদ থাক। অথবা জিজিয়া দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হও, এবং তোমরা ও তোমাদের জনগণ আমাদের নিরাপত্তা লাভ করবে, অন্যথা ফলাফল নিয়ে তোমরা নিজেদেরকেই দায়ী করবে, তোমরা জীবনকে যেভাবে আকাঙ্ক্ষা কর আমি মৃত্যুকে সেভাবে আকাঙ্ক্ষা করি। — খালিদ বিন ওয়ালিদ

মক্কার কুরাইশ বংশের বনু মাখজুম গোত্রে খালিদ বিন ওয়ালিদের জন্ম হয়।মূল নাম খালিদ, উপনাম আবু সুলায়মান ও আবুল ওয়ালীদ। লক্বব সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারী)। মূতার যুদ্ধে অসমান্য অবদানের জন্য তিনি ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত হন।খালিদের জন্ম তারিখ সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, নবুয়তের ১৫ অথবা ১৬ বছর পূর্বে তাঁর জন্ম হয়। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) ৬৩৯ খ্রিঃ কিছুদিন অসুস্থ হন এবং ৬০ বছর বয়সে মদীনাতে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, তিনি ‘হিমছ’-এ মৃত্যুবরণ করেন। তবে এ মত ঠিক নয় বলে ধারণা করা হয়। কারণ খলীফা উমর (রাঃ) তাঁর যানাযায় উপস্থিত হন বলে ধারণা করা হয় ।

খালিদের মৃত্যুতে উমার (রাঃ) আফসোস করে বলেছিলেন, ‘নারীরা খালিদের মত সন্তান প্রসবে অক্ষম হয়ে গেছে।’ খালিদ তার প্রতিটা যুদ্ধে শহিদ হবেন এই আশা নিয়েই বের হতেন কিন্তু শাহাদত তার ভাগ্যে ছিলোনা। মৃত্যুর আগে বিছানায় শুয়ে তাই তিনি আফসোস করতেন। খালিদের স্ত্রী তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন –

“আপনাকে সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তলোয়ার) উপাধি দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর তলোয়ার ভাঙতে পারে না আর তাই আপনি শহিদ হিসেবে নয় বরং বিজয়ী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন।”

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –