• বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৮ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইসলামে ওজুর বিকল্প তায়াম্মুম (পর্ব-২)

লালমনিরহাট বার্তা

প্রকাশিত: ২ ডিসেম্বর ২০১৮  

ইসলামে ওজুর বিকল্প বা তায়াম্মুমের বিধান (পর্ব-১) এ তায়াম্মুম কি, এর পরিচয়, তায়াম্মুমের পটভূমি, তায়াম্মুমের নিয়মাবলী, এর ফরজ ও সুন্নত পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আজকের আলোচনায় যে বিষয়গুলো আলোকপাত করা হবে সেগুলো হলো: যেসময়গুলোতে তায়াম্মুম করা যায় বা করতে হয়, যেসব বস্তু বা যা দ্বারা তায়াম্মুম করা যায়, যে কাজগুলোর দ্বারা তায়াম্মুম নষ্ট হয় ইত্যাদি ।

তায়াম্মুম:

কোরআন দিয়েছে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান। পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম হচ্ছে ওজু ও গোসল। যখন পানি পাওয়া যাবে না অথবা কোনো লোক অসুস্থ হয়ে পানি ব্যবহারে অপারগ। এ অবস্থায় পবিত্রতা অর্জনের করণীয় কী? এর পরিপ্রেক্ষিতেই নাজিল হয়েছে তায়াম্মুমের বিধান। তায়াম্মুম কি?

তায়াম্মুম (التيمم) অর্থ ‘সংকল্প করা, ইচ্ছা করা’। পারিভাষিক অর্থে- ‘পানি না পাওয়া গেলে ওজু বা গোসলের পরিবর্তে পাক মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের ইসলামী পদ্ধতিকে ‘তায়াম্মুম’ বলে’। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে তায়াম্মুমের কথা উল্লেখ করেছেন।

তায়াম্মুম করা সম্পর্কে নবীজী (সা.) এর একটি হাদিস রয়েছে। সেটি হলো-

সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি হজরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রা.) এর নিকট এসে বলল, আমি নাপাক হয়েছি, কিন্তু পানি পেলাম না। এসময় আম্মার ইবনু ইয়াসার হজরত ওমর (রা.)-কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার কি স্মরণ নেই যে, এক সফরে আমি ও আপনি উভয়ে ছিলাম। উভয়ে নাপাক হয়েছিলাম, কিন্তু আপনি পানির অভাবে সালাত আদায় করলেন না, আর আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিলাম এবং সালাত আদায় করলাম। অতঃপর এক সময় আমি এটা নবী করীম (সা.) এর নিকট বিবৃত করলাম। তিনি বললেন, তোমার জন্য এরূপ করাই যথেষ্ট ছিল। এই বলে তিনি স্বীয় হাতের করদ্বয় জমিনের ওপর মারলেন এবং উভয় হাতে ফুঁ দিলেন। অতঃপর উভয় হাত দ্বারা মুখমন্ডল ও দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নম্বর: ৩৩৮)

যেসকল অবস্থায় তায়াম্মুম বৈধ:

যেসব পরিস্থিতিতে তায়াম্মুমের হুকুম রয়েছে সেই সময় বা পরিস্থিতি গুলো হলো:

১. যদি পানি না পাওয়া যায়,

২. পানি পাওয়া গেলেও তা নাগালের বাইরে,

৩. পানি ব্যবহারে ক্ষতির আশংকা,

৪. যেসব নামাজের কাজা নেই ( যেমন- জানাজা ও ঈদের নামাজ ইত্যাদি) তা ওজু করলে নাপাওয়ার আশংকা থাকলে।

 

এগুলো ছাড়াও বাস্তবিক ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতিগুলোর সম্মুখীন হতে হয় সেগুলো হলো:

১. উড়োজাহাজ, মোটরবাস বা রেল গাড়ীতে চলাচলের সময় যদি ওজুর জন্য পানির ব্যবস্থা করতে না পারে,

২.রোগী এমন অসুস্থ যে পানি দিয়ে ওজু করলে রোগ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে,

৩. দুরে পানি আছে কিন্তু সেখানে যেয়ে ওজু করলে নামাজের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়,

৪. কাছে খাওয়ার পানি আছে, কিন্তু তা দিয়ে ওজু করলে পিপাসায় কষ্ট হবে,

৫. মোটরগাড়ী চলাচলের পাশে পানি আছে কিন্তু চালক গাড়ী থামাতে চায় না অথবা থামিয়ে ওজু করলে পরবর্তী বাস ট্রেন ফেল করার সম্ভাবনা থাকে,

৬. কোনো ব্যক্তির ওপর গোসল ফরজ হয়েছে কিন্তু গোসলের জন্য পানি না পায়,

৭. পানি আছে কিন্তু রোগগ্রস্থ ব্যক্তি ফরজ গোসল করলে রোগ বৃদ্ধি হবে,

৮. নিকটে পানি আছে কিন্তু হিংস্র জন্তু বা শত্রুর আক্রমণের ভয় থাকে,

৯. শহরের বাসায় পানি নেই। পানির জন্যে অপেক্ষা করুন। যদি দেখেন নামাজের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে দেরী না করে তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ে নিন।

 

তায়াম্মুম করার উপকরণ:

এবং যা কিছুর দ্বারা তায়াম্মুম করা সঠিক হবে তা হলো:

১. মাটি

২. বালি

৩. বিভিন্ন ধরনের পাথর, যেমন কালো পাথর, মারমার (মার্বেল) পাথর, চুনা পাথর ইত্যাদি

৪. পোড়া কাদা-মাটি যেমন ইট ও কলস।

 

এ সম্পর্কে হাদিসে এবং বিভিন্ন সাহাবিগণ বলেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (র.) ও মুহাম্মদ (র.) এর মতে মৃত্তিকা জাতীয় যে কোনো বস্তু দ্বারা তায়াম্মুম বৈধ। যেমন-মাটি, বালু, পাথর, সুরকি চুনা, সাধারণ চুনা, সুরমা ও হরিতাল।

ইমাম আবূ ইউসূফ (র.) বলেন, মাটি ও বালু ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা তায়াম্মুম বৈধ হবে না। ইমাম শাফিঈ (র.) বলেন, উৎপাদনকারী মাটি ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা তায়াম্মুম বৈধ হবে না। আবূ ইউসূফ থেকেও এরূপ বর্ণনা রয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘তোমরা পবিত্র (অর্থাৎ উৎপাদনকারী) মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করবে।’ অর্থাৎ উৎপাদনকারী মাটি দ্বারা এ কথা ইবন ‘আব্বাস (রা.) ও বলেছেন। তবে ইমাম আবূ ইউসূফ (র.) আমাদের বর্ণিত পূর্বলিখিত হাদীসের কারণে মাটির সঙ্গে বালু বর্ধিত করেছেন।

তায়াম্মুম নষ্ট হবার কারণ :

তায়াম্মুম নষ্ট হওয়ার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে। যেগুলো হলে তায়াম্মুম ভেঙ্গে যায় যথা:

১. নিয়ত না করিলে,

২. পবিত্র মাটির মাধ্যমে তায়াম্মুম না করিলে,

৩. সে সকল বিষয়ের মাধ্যমে ওজু নষ্ট হয়ে যায়, সে সব কারণে তায়াম্মুমও ভঙ্গ হয়ে যায়,

৪. মাটিতে দুইবার হাত না মারলে,

৫. তায়াম্মুমের নির্ধারিত জায়গাসমূহের কোনো স্থানে মাসেহ বাদ পড়লে,

৬. পানি পাওয়া গেলে এবং পানি ব্যবহারের সামর্থ অর্জন করলে অর্থাৎ রোগী রোগমুক্ত হলে।

 

তবে যদি সালাত শুরু হওয়ার পরে পানি পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে হাদিসে বর্ণিত আছে যে, পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করার পরে পানি পাওয়া গেলে সালাত বাতিল হবে না। অর্থাৎ পূনরায় ওজু করে সালাত আদায় করতে হবে না। কেননা পানি না পাওয়ার কারণে ওজুর পরিবর্তে তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে সালাত আদায় করা হয়েছে।

হাদীসে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা দুই ব্যক্তি সফরে বের হয়। পথিমধ্যে সালাতের সময় উপনীত হলো তারা পানি না পাওয়ায় তায়াম্মুম করে সালাত আদয় করল। অতঃপর উক্ত সালাতের সময়ের মধ্যে পানি প্রাপ্ত হওয়ায় তাদের একজন অওজু করে পূনরায় সালাত আদায় করল এবং অপর ব্যক্তি সালাত আদায় হতে বিরত থাকল। অতঃপর উভয়েই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর খিদমতে হাজির হয়ে এই ঘটনা বর্ণনা করল।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমাদের যে ব্যক্তি পুনরায় ওজু করে সালাত আদায় করেনি সে সুন্নাত অনুযায়ী কাজ করেছে এবং এটাই তার জন্য যথেষ্ট’। আর যে ব্যক্তি ওজু করে পূনরায় সালাত আদায় করেছে তার সম্পর্কে বলেন, ‘তুমি দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হয়েছ’। (আবু দাউদ, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, অনুচ্ছেদ, হা/৩৩৮)

পরিশেষে...তায়াম্মুম বান্দার জন্য মহান আল্লাহর অন্যতম অনুগ্রহ। পানি না পেলেও যেন বান্দা তার প্রভুকে ভুলে না যায় তার ইবাদত করতে পারে, তাই আল্লাহ তায়ালা তায়াম্মুমের বিধান করে দিয়েছেন।

মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ সবাইকে তার হুকুম-আহকাম পালনে সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –