• শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ২ ১৪৩১

  • || ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

২০০ বছরের ‘হালা বটের তল’ গাছটি আর নেই

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২ জুন ২০২৪  

লালমনিরহাটে ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘হালা বটের তল’ নামের সেই বিখ্যাত হালা বটগাছটি ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। গাছটি ভেঙে পড়ায় স্থানীয় অনেক মানুষ কেঁদেছেন, দুঃখপ্রকাশ করেছেন জেলার জনপ্রতনিধিরা।

শনিবার (১ জুন) দিবাগত রাতে আকাশে মেঘের ঘনঘটার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ঝড় আর প্রচণ্ড বৃষ্টি। এই ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যেই মর মর বিকট শব্দে হঠাৎ ভেঙে পড়ে বটগাছটি। এই বটগাছের নামেই এখানকার নামকরণ করা হয় হালাবটের তল।


ক্রমাগত সবুজ হারানো এই বটগাছটি লালমনিরহাট শহরের হালাবটের তল হিসেবে পরিচিত সবুজের এক বড় আশ্রয়কেন্দ্র। এ বটগাছটির তলে রয়েছে প্রচুর ঘাস, তাই এই গাছের পাশ দিয়ে কোনো পথচারী হেঁটে গেলেই এখানে শুয়ে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর রওয়ানা দেন। হঠাৎই ঝড়ে ভেঙে পড়ে লালমনিরহাটের ঐতিহ্যবাহী ২০০ বছরের এই বটগাছটি।


ঐ বটগাছটি নিয়ে দেশের স্বনামধন্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়েছে ফিচার নিউজ। প্রায় প্রতি শুক্রবার যেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দর্শনার্থীরা ভিড় জমান এই হালা বটের গাছটি দেখার জন্য। অনেকে মনের বাসনা পূরণ করতেও মানত করতে আসেন এখানে। কয়েকশ’ বছরের এই বটগাছটি ভেঙে পড়ায় আজ থেকে এখানে আর কেউ আসবে না। ঐ গাছটিকেও আর দেখা যাবে না।


ভেঙে পড়া বটগাছের পাশে দাঁড়ানো একাধিক প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা জন্মের পর থেকে এই গাছটিকে এরকমই দেখে আসছে। লালমনিরহাটের পুরাতন ঐতিহ্যের গাছগুলোর মধ্যে এই বটগাছ অন্যতম। হঠাৎ ঝড়ে ভেঙে পড়ায় লালমনিরহাটবাসী একটি ঐতিহ্যবাহী বৃক্ষ হারালো।


সদ্য নির্বাচিত লালমনিরহাট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন বলেন, ‘গাছটি ভেঙে পড়ার খবরটি পেয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যাই। গাছটি যেভাবে ভেঙে পড়েছে, মনে হয় না আমরা রক্ষা করেতে পারবো। কিন্তু তবুও আমি এলাকাবাসীদের বলেছি, নিজেও চেষ্টা করছি যদি গাছটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। গাছটি ভেঙে পড়ায় তিনজন ব্যক্তি আহত হন। আমি তাদের দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম।’


এ বিষয়ে মন্তব্য নেয়ার জন্য স্থানীয় কাউন্সিলর ও পৌর মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা মুঠোফোনে কল রিসিভ করেননি।


স্থানীয়রা জানান, গাছটি যে জায়গায় রয়েছে তা লালমনিরহাট পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর সাপটানা এলাকার অন্তর্গত। শনিবার রাতে প্রবল বেগে ঝড় আসে। ঐ ঝড়ে গাছটি হুট করে ভেঙে পড়ে। সেসময় ঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে গাছের নিচে অবস্থিত মিনারে আশ্রয় নেয়া তিনজন ব্যক্তি গাছের নিচে চাপা পড়েন। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। বর্তমানে তাদের দুইজন লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহতরা হলেন- মো. আতিক, মো. উজ্জল ও মো. মেহেদী। তারা একই এলাকার বাসিন্দা।


হালাবটের তলের খাদেম আকবর আলী বলেন, ‘ আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে আমি এই গাছের সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। আমার অনেক কান্না পাচ্ছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা আনিছুল ইসলাম বলেন, ‘রাতে কিছুক্ষণ ঝড় হাওয়ার পরে মর মর বিকট শব্দে হঠাৎ ভেঙে পড়ে এই বটগাছটি। এখানে অনেক দর্শনার্থী আসতেন। গাছটিকে ঘিরে আমাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। এই গাছের ছায়ায় অনেকে বিশ্রাম নিতেন। এই গাছের কথা আর কেউ মনে রাখবে না। গাছটি ভেঙে পড়ায় আমার দোকানের ব্যবসা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’


উল্লেখ্য, প্রায় দেড় একর জমিজুড়ে বিস্তৃত অতি পুরানো এ বটগাছের অবস্থান লালমনিরহাট পৌরসভাধীন সাপটানা (উত্তর) মৌজায় লালমনিরহাট-কুলাঘাট সড়কের উত্তর পাশে।


জনশ্রুতি আছে, বটগাছটির বয়স নূন্যতম ২০০ বছর। গাছের নিচের ঈদের মাঠটি আরো পুরানো। ইংরেজ আমলে (১৯৩৫-৪০ খ্রিষ্টাব্দে) স্থানীয় এক খতিব ফকির জৌনপুরের জনৈক পীর সাহেবকে এনেছিলেন এই বটগাছের নিচে ওয়াজ করার জন্য। পীর সাহেব এ গাছের নিচে বসে ওয়াজও করেছিলেন। ওয়াজ মাহফিলে আগত লোকজনদের ওজু করার জন্য মাঠের পাশে একটি কুয়া খনন করাও হয়েছিল। কিন্তু কুয়ায় পানির অপর্যাপ্ততার কারণে ওজু করার সমস্যা সৃষ্টি হয়। এতে পীর সাহেব এক বদনা পানি নিয়ে সেটি কুয়ায় ঢেলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে আর ওজুর পানির অভাব হয়নি। আবার ওয়াজ শেষে খিচুড়ি বিতরণের সময় তাও কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে পীর সাহেব খিচুড়ির হাঁড়ির মুখে ঢাকনা দেন। পরে তার নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকনা একটু সরিয়ে খিচুড়ি বিতরণ শুরু করা হয়। ঐ হাঁড়ির খিচুড়ি আগত লোকজনের মাঝে বিতরণ শেষে পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের লোকজন যারা ওয়াজ শুনতে আসেনি তাদের জন্যও পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। পীর সাহেব ওয়াজ করে চলে যান, কিন্তু ওয়াজ করার মাঠটি এলাকার লোকজনের কাছে পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সাহেবকে ছায়াদানকারী বট গাছটির প্রতিও বিশেষ সম্মান দেখানো শুরু হয়। দু-একজন এখানে এসে মানত করে সুফল পাওয়ার পর পাকিস্তান আমলেই মানতের প্রচলন হয়। আর তা ব্যাপকভাবে লাভ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। এখনও প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক লোকজনকে মানতের উদ্দেশে এখানে আসতে দেখা যায়।
 

– লালমনিরহাট বার্তা নিউজ ডেস্ক –